জলবায়ু পরিবর্তন ও সমন্বিতভাবে কৃষিতে খাপখাওয়ানোর টেকসই কৌশল
ড. জগৎ চাঁদ মালাকার
বাংলাদেশ পৃথিবীর কৃষিপ্রধান একটি দেশ। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। ভৌগোলিক অবস্থান ও বিপুল জনগোষ্ঠীর কৃষির উপর নির্ভরশীলতার কারণে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির তালিকায় বাংলাদেশ উপরের দিকে অবস্থান করছে। খরা, লবণাক্ততা, বন্যা, সাইক্লোন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, বহিঃদেশের বালাইয়ের অনুপ্রবেশ, নদীভাঙন ইত্যাদি বাংলাদেশের কৃষিকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছে। বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি জোগানের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাই ক্ষুদ্র দেশের বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত জরুরি।
বর্তমান বিশ্বে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বৈশিক উষ্ণতা নামে অধিক পরিচিত। বৈজ্ঞানিক ভাষায় একে গ্রিনহাউজ প্রভাব বলা হয়। এই পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বিশ্বের যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কৃষিতে জলবায়ুর প্রভাব আজ আর তেমন অজানা নয়। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ঝড়, বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন প্রকার নানা প্রকারের দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে প্রতি বছরে লক্ষ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে আমাদের কৃষি। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা এ ধরনের আকস্মিক বন্যার শিকার। জোয়ারজনিত বন্যা উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি করে। জমিতে লবণাক্ত পানির জলাদ্ধতার সৃষ্টি করে, যা ফসল চাষের জন্য অনুপযোগী। সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, নীলফামারী ইত্যাদি জেলা আকস্মিক বন্যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিপক্ব ফসল কর্তনের আগেই প্রতি বছর হাজার হাজার একর পাকা বোরো ধান আকস্মিক বন্যায় আক্রান্ত হয় ফলে চাষি হয় ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশের মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি বর্তমানে প্রায় ১০,৫০০০০ হেক্টর। গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের লোনাপানি দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নদীতে প্রবেশ করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কৃষি ক্ষেত্রে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোতে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। কোন এলাকায় বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীকরণের মাত্রা বেশি হলে সেখানে খরা দেখা দেয়। এপ্রিল থেকে মধ্য নভেম্বরের মধ্যে পরপর ১৫ দিন বৃষ্টি না হলে কৃষিতে খরা দেখা যায়। প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার খরায় আক্রান্ত হয়। গাছের বৃদ্ধি পর্যায়ে গড় বৃষ্টিপাতের অভাবে মাটিতে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হয়, যা গাছের ক্ষতি করে। দেশে বিভিন্ন মাত্রার খরায় আক্রান্ত ৮৩ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমির শতকরা ৬০ ভাগ জমিতে আমন ধান চাষ করা হয়। এ ছাড়াও খরা আউশ ও বোরো ধান, পাট, ডাল ও তেল ফসল, আলু, শীতকালীন সবজি এবং আখ চাষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে উফশী ধানের ফলন কমে যাবে এবং গমের রোগের আক্রমণ বাড়বে। বাংলাদেশে বর্তমানের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে গম চাষ সম্ভব হবে না। ধান গাছের কচি থেকে ফুল ফোটার সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি হলে এবং অতি নিম্নতাপে (২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে) শিষে ধানের সংখ্যা কমে যেতে পারে। ফুল ফোটা বা পরাগায়নের সময় যদি অতি উষ্ণ তাপ থাকে তাহলে চিটার সংখ্যা থোড় অবস্থার চেয়ে বেশি হবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ফসলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়, অতি বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়, খড়ায় ফসলে পোকার আক্রমণ বেশি হয়, ফসলের বৃদ্ধি কম হয় এবং ফলন কমে যায়, সঠিক সময় বীজতলা করা যায় না, বন্যা/অতিবৃষ্টিতে সবজি পচে যায়, ফলফুল ঝরে যায়, সময়মতো ফসলের চাষাবাদ করা যায় না, কুয়াশায় পরাগায়ন ব্যাহত হয়, আমের মুকুল ঝড়ে যায়, আলুর মড়ক দেখা যায়, রবি শস্যের ফলন কমে যায় প্রভৃতি। পরিবর্তিত জলবায়ুতে কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই খাপখাওয়ানোর নিমিত্তে দুর্যোগভিত্তিক নিম্নোক্ত টেকসই কৌশল অবলম্বন গ্রহণ করতে হবে।
বন্যা জলমগ্নতা খাপখাওয়ানোর কৌশল : বন্যাসহিষ্ণু জাত রোপণ করতে হবে। উঁচুস্থানে বেড ও মাদা তৈরি করা প্রয়োজন। পলিথিন দিয়ে বেড, মাদা ঢেকে দিতে হবে। বন্যা /পানি সহিষ্ণু জাত ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২, ব্রি ধান৭৯ বিআর২২, বিআর২৩ চাষ করা। বেড়িবাঁধ ভাঙলে মেরামত করা। মাছের ক্ষেত্রে উঁচু করে পাড় মেরামত করা এবং নেট দেওয়া। স্বল্প মেয়াদি বিনা ধান-৭, বিনা ধান-১৬, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৯, বিউ ধান-১ প্রভৃতি চাষ করা। ভাসমান বীজতলা তৈরি করা। কচুরিপানায় মাদা তৈরি করা এবং ভাসমান মাদায় সবজি এবং ফল চাষ করা। পুকুর খনন করে পাড় উঁচু করা। বন্যার আগে বিভিন্ন প্রকার খাবার সংগ্রহ করে রাখা। মাছ আগে ধরে কোথাও বিক্রি করা। হাঁস-মুরগির প্রতিষেধক টিকা বন্যার আগে দেওয়া। হাঁস-মুরগির ঘরের মেঝ চুন/ছাই ছিটানো। বন্যার পানি সরে গেলে রোপা আমন মৌসুমের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শাইল জাতের যেমন: বিনাশাইল, নাইজারশাইল, ঝিঙাশাইল, রাজুশাইল, ইন্দ্রোশাইলসহ স্থানীয় জাতের ধান চাষ করা যায়।
খরা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে খাপখাওয়ানোর কৌশল : মাঠের কিনারায় গভীর মিনিপুকুর খনন করা এবং ধানক্ষেতে মাছ চাষ। খড়াসহিষ্ণু ব্রি ধান৪৩, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৮৩, বিনা ধান-১৭, বিনা ধান-১৯, তিল, তিসি, ঢেঁড়স- পুঁইশাক চাষ করা। জৈবসার প্রয়োগ করা। গভীর নলকূপ, পাম্প মেশিনের মাধ্যমে সেচ দেয়া বিশেষ করে ধানের পরাগায়নের সময় ক্ষেতে পানি ব্যবস্থা রাখা। মালচিং দেয়া। খড়াসহিষ্ণু জাতের ঘাসের জাত আবাদ করা। আগাম রোপা আমন চাষ ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৯, বিনা ধান-১৬, জাত চাষ করা। আইল উঁচু করে পানি সংরক্ষণ করা। সেচের পানির অপচয় রোধ করা (পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকানো পদ্ধতি)। খরা প্রতিরোধী কুল খেজুর, ড্রাগন ফল চাষ করা।
লবণাক্ততা বৃদ্ধি মোকাবেলায় খাপখাওয়ানো কৌশল : বেড়িবাঁধ উঁচু করতে হবে। মাঠের কিনারায় গভীর খনন করা এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সেচকাজ পরিচালনা করা। জমির আইল উঁচু করতে হবে। জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। লবণাক্ত সহিষ্ণু জাত ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৬৭, বিনা ধান-১০, বিনা গম-১ লাগাতে হবে। জমিতে গভীর চাষ দিতে হবে। ডালজাতীয় ফসলের আবাদ করতে হবে করা। সর্জন পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। ধানের পর গম চাষ করতে হবে- পর পর ২-৩ বছর।
শৈত্যপ্রবাহ/কুয়াশা সাথে খাপখাওয়ানোর কৌশল : শাকসবজি এবং ধানের বীজতলা ঢেকে দেওয়া। বোরো বীজতলায় সন্ধ্যে বেলায় ঢেকে দেয়া, সেচ দেয়া, ছাই দেয়া। বোরো বীজতলায় বায়ু চলাচল প্রতিবন্ধকতার জন্য বেড়া দেয়া। ছত্রাকনাশক ওষুধ ব্যবহার করা। আমের মুকুলে পানি স্প্রে করা। হাঁস-মুরগির ঘর চট দিয়ে ঢেকে রাখা। ছাগলের জন্য মাচার ব্যবস্থা করা।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের লক্ষ্যে পরিবর্তনশীল জলবায়ুতে পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ ও টেকসই উৎপাদনক্ষম উত্তম কৃষি কার্যক্রম প্রবর্তন রয়েছে, যাতে প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষাসহ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। জলবায়ুর বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপখাওয়ানোর জন্য বিশেষ করে বিভিন্ন অভিযোজন কলাকৌশল রপ্ত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীকে সচেতন করা একান্ত প্রয়োজন।
লেখক : উপপরিচালক (এলআর), ডিএই। মোবাইল : ০১৭১৬০০৪৪০০, ই-মেইল : jagot_mala@yahoo.com